বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:০৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ডিমের মূল্যবৃদ্ধি অপুষ্টিতে নিম্ন আয়ের মানুষ

নিতাই চন্দ্র রায়:
ডিম নিয়ে চলছে এক তুঘলকিকাণ্ড। প্রতিদিই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরিবের প্রাণিজ প্রোটিন; ডিমের দাম। মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব পুষ্টি উপাদান রয়েছে ডিমে। ডিমে যেহেতু মাছের মতো কোনো কাঁটা নেই, তাই শিশু-কিশোরদের কাছে এটি একটি অতি লোভনীয় খাদ্য ও প্রোটিনের আদর্শ উৎস। যারা মাছ, মাংসের মতো উচ্চমূল্যের প্রাণিজ প্রোটিন কিনতে পারেন না, তারাই ডিমের ক্রেতা। সহজ রন্ধন পদ্ধতির জন্য ডিম মেস, ছাত্রাবাস ও গার্মেন্টকর্মীদের পছন্দনীয় খাবার। এক সপ্তাহ আগে ফার্মের যে লাল ডিমের হালি ছিল ৪৪ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ টাকা। এক বছর আগে যখন পোলট্রি ফিডের দাম বর্তমানের চেয়ে বেশি ছিল তখনো ডিমের এত উচ্চমূল্য ছিল না। ডিমের মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে বড় ব্যবসায়ীরা দায়ী করছেন করপোরেট ব্যবসায়ীদের। আর খামারিরা আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের। আমাদের দেশে সাধারণত হাঁস, মুরগি ও কোয়েল পাখির ডিম পাওয়া যায়।

গত ৭ আগস্ট থেকেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডিমের দাম। এক ডজন ডিমের দাম দাঁড়িয়েছে ১৬৫ টাকা। কোথাও বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে। খুচরা দুটি ডিম কিনতে গুনতে হচ্ছে ৩০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই দাম বাড়তি। পোলট্রি শিল্প অ্যাসোসিয়েশন বলছে, করপোরেট ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ডিম ও মুরগির দাম বাড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ডিমের বাজারের কারসাজি খুঁজতে দেশে অভিযানে নামার ঘোষণা দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে প্রতিহালি ডিমের দাম অন্তত ৫ টাকা বেড়েছে। তবে গত বছর জুনেও ৮৬-৯০ টাকায় এক ডজন ডিম পাওয়া গেছে। সেই হিসাবে ১৪ মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ময়মনসিংহের মেছুয়া বাজারের একজন খুচরা ব্যবসায়ী ১৫ দিন আগে এক ডজন লাল ডিম ১৪৪ টাকায় বিক্রি করেছেন। এখন সেই ডিম তাকে বিক্রি করতে হচ্ছে ১৭০ টাকায়। কিনতেই হচ্ছে ১৫৫ টাকায়। তার মধ্যে একটা ডিম ফেটে গেলে বা নষ্ট হলেই ১৩ টাকা লোকসান। একদিকে বাজারে মাছ-মাংসের দাম চড়া, তার মধ্যে ডিমের দাম এভাবে বাড়ায় নিম্নআয়ের পরিবারগুলোয় আমিষের ঘাটতি অপুষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ডিমের দাম হঠাৎ বৃদ্ধির ব্যাপারে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ডিমের দাম বৃদ্ধির জন্য করপোরেট সিন্ডিকেট দায়ী। ফিডের দাম বাড়িয়ে তারা বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে তাদের সঙ্গে চুক্তি করলে তারা কিছুটা কম দামে ফিড ও মুরগির বাচ্চা দেয়। অন্যথায় বেশি দামে ফিড কিনতে হয়। এ কারণে লোকসান দিতে গিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ের অধিকাংশ ছোট খামার বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বাজারে সরবরাহের ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যার খেসারত দিচ্ছে জনগণ। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রান্তিক পর্যায়ে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৮৭ পয়সা থেকে ১১ টাকা পর্যন্ত। ফিড নিজেদের হওয়ায় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকার কম। ১৩ টাকায় বিক্রি করলেও লাভ থাকে। কিন্তু তারা তা করে না। এসএমএস দিয়ে বাড়ায়-কমায় ডিমের দাম।

পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০২১ সালে ১ কেজি ভুট্টার দাম ছিল ২৮ টাকা, ৫০ কেজির ১ বস্তা পোলট্রি ফিডের দাম ছিল ২৫০০ টাকা, ২০২২ সালের শুরুতে ভুট্টার দাম একই থাকলেও ফিডের দাম বস্তায় ২০০ টাকা বাড়ে। এরপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দোহাই দিয়ে লাগামহীন ফিডের দাম বাড়ানো হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভুট্টার কেজি ৪১ টাকা হলে ফিডের ৫০ কেজি বস্তার দাম পৌঁছায় ৩ হাজার ৭৪০ টাকায়। মার্চে ভুট্টার দাম কমে ২৬ টাকার নিচে নামলেও ফিডের দাম কমানো হয় কেজিতে মাত্র ৩ টাকা। অথচ, বাড়ানো হয়েছিল কেজিতে ২০ টাকার বেশি। এখন অনায়াসে প্রতি কেজি ফিডের দাম কমপক্ষে ১০ টাকা কমানো সম্ভব। তাহলে প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ দেড় টাকা কমত। সরকারকে এটা দেখতে হবে। না হলে পোলট্রি শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে ৫০ লাখ ক্ষুদ্র খামারি।

এদিকে হঠাৎ ডিমের বাজার অস্থির হয়ে ওঠায় সম্প্রতি রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ডিমের আড়তে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ডিমের বড় একটি দোকানে ডিম কেনা এবং বিক্রির দামে বড় ফারাক দেখতে পেয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা করা হয়। ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে এখন থেকে সারা দেশে অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। উৎপাদন খরচসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, একটি ডিমের খুচরা দাম ১২ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় বলে জানিয়েছেন এ খাতের করপোরেট ব্যবসায়ীরা। তাদের কথা বড় খামারি পর্যায়ে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ এখন ১০ টাকা ৩১ পয়সা। ছোট খামারিদের ক্ষেত্রে ১০ টাকা ৭৫ পয়সা। সব বিবেচনায় এখনই দেশে ডিমের দাম ১০ টাকার নিচেও নামবে না বলে মনে করেন তারা। সম্প্রতি রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও বাংলাদেশ পোলট্রি ফোরাম (বিপিআইসিসি) আয়োজিত এ কর্মশালায় এসব কথা বলেন বক্তারা।

তবে ডিমের দাম ১০ টাকার নিচে নামার সম্ভাবনা নেই। কারণ যখন ডলারের দাম ৮৬ টাকা ছিল তখন প্রতিটি ডিম ৯ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি করা হতো। বর্তমানে ডলারের দাম সরকারিভাবে ১০৯ টাকা হলেও ব্যাংকে বিক্রি হচ্ছে ১১৩ থেকে ১১৪ টাকা। ফলে ডলারের দাম ভবিষ্যতে ১০০ টাকার নিচে নামবে বলে মনে হয় না এবং ডিমের দামও ১১ টাকার নিচে নামবে না। বিপিআইসিসির সভাপতি আরও বলেন, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি দেখা দিলেই বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। এখন খুঁজে বের করতে হবে কারা এর সঙ্গে জড়িত? অন্যদিকে মুরগির খাদ্যের কাঁচামাল ও ওষুধ আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিলে মুরগি ও ডিমের দাম অবশ্যই কমানো সম্ভব। ব্রিডার্স অ্যাসোসিশেন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সভাপতি বলছেন ভিন্ন কথা সিন্ডিকেটের অভিযোগ ঠিক নয়। ডিম ও মুরগির দাম কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না। এটা নির্ভর করে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। এখন ডিমের জোগান কমেছে। ডিম ধরে রেখে দাম বাড়ানো সম্ভব নয়। খামারি ডিম ধরে রাখলে উল্টো তার লোকসান হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ডিমের উৎপাদন কমে গেছে। করপোরেট পর্যায়ে এখন ডিমের উৎপাদন হচ্ছে ৬০ লাখের মতো। আর ছোট খামারি পর্যায়ে ৩ কোটি ৩৩ লাখ। সব মিলিয়ে ডিমের উৎপাদন ৪ কোটির নিচে। ফিড অ্যাসোসিয়েশনের কথা অনেকগুলো পণ্যের সমন্বয়ে মুরগির খাবার তৈরি করতে হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ উপকরণই আমদানিনির্ভর। ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানি খরচ বেড়েছে। তাই ডিমের দাম সাধারণ ভোক্তার সামর্থ্যরে মধ্যে রাখতে হলে ১. মুরগির খাদ্যের দাম কমাতে হবে। ২. খাদ্য ও ওষুধের ওপর আরোপিত কর কমাতে হবে। ৩. প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে প্রাণিসম্পদ চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। ৪. উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের মাঠ ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৫. কৃষির মতো পোলট্রি শিল্পে বিদ্যুতে ভর্তুকি দিতে হবে। ৬. করপোরেট খামারিদের অশুভ তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। ৭. বাজার মনিটরিংকালে বেশি দামে ডিম বিক্রির কাজে নিয়োজিতদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ৮. বন্ধ খামারগুলো অবিলম্বে চালু করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সরকারি প্রণোদনা ও স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে। এখন সরকারকেই ভাবতে হবে, কোন পথে তারা যাবে?

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION